১৯৫৩ সালে চাঁদপুর জেলার মতলব থানার পাঁচঘড়িয়া গ্রামের এক মধ্যবিত্ত পরিবারে তাঁর জন্ম। ছয় ভাই-বোনদের মধ্যে সে দ্বিতীয় এবং ভাইদের মধ্যে প্রথম সন্তান। বাবা সেকান্দর আলী খান বিদেশী জাহাজে চাকুরি করতেন। বহুদিন পর পর তিনি বাড়িতে আসতেন। পুরো পরিবারটা সামলে রাখতেন তাঁর মা ‘আম্বিয়া খাতুন। ছয় ভাই-বোনকে মা-ই পড়ালেখা ও লালন-পালন করাতেন। তাঁকে আত্মীয় স্বজনরা ‘মুকুল , গ্রামের লোকেরা নামটি বিকৃত করে তাঁকে ‘মকুন খা’ বলে ডাকতো। শৈশব থেকেই খুব ডানপিঠে স্বভাবের ছিলেন তিনি। যখন যা মন চাইতো তাঁই করতো। খেলাধুলা হৈ-হুল্লোর করেই বেড়ে উঠেছেন। পড়ালেখায় মন বসেনি কখনোই। বন্ধু আর গ্রামের মানুষ, এলাকার মানুষ এই নিয়েই তাঁর দিন-রাত। স্কুলে পড়া অবস্থাতেই সে তাঁর বন্ধুরা মিলে স্কুলটি অন্য ইউনিয়ন থেকে নিজ ইউনিয়নে নিয়ে আসেন। গ্রামের লোকদের উদ্বুদ্ধ করে কয়েক একর জমি নিয়ে স্কুল স্থাপন করেন। মেয়েদের জন্য আলাদা একটি স্কুল আছে, তাঁর নাম নারায়নপুর বালিকা বিদ্যালয়। দুটি স্কুলের জন্য কয়েক একর জমি সংগ্রহ করে মাঠ তৈরি করেন, তিনটি পুকুর তৈরি করেন। একটি ঈদগাহ তৈরি করেন। পাঁচঘড়িয়া, আধারা, খিদিরপুর তিনটি গ্রাম নিয়ে একটি সমাজ। সমাজের মানুষদের একত্রিত করার লক্ষে ইদগাহ তৈরি করেন এবং প্রতিবছর সকলেই একসাথে দুটি ঈদের নামাজ পড়েন। গ্রামের মানুষকে বিদুৎ সুবিধা দেওয়ার জন্য নেতা ও প্রশাসনের লোকদের ম্যানেজ করে ১৯৮৮ সাথে বিদুৎ দেওয়ার ব্যবস্থা করেন। তিনি স্কুল মাঠে কিছুদিন পরপর ১৬ টিম বা ৩২ টিমের খেলা ছাড়তেন। দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে বিভিন্ন দল এই খেলায় অংশগ্রহণ করতো। মাসব্যাপী বা তাঁরও বেশী সময় ধরে এই আয়োজন চলতো। স্বাধীনতাপূর্বে এই দেশে টিভি-রেডিও তেমন ছিলনা। বিনোদনের মাধ্যম ছিলো নাটক-যাত্রা মঞ্চায়ন। তিনি দল গঠন করে গ্রামে গ্রামে মঞ্চায়নের ব্যবস্থা করতেন। মানুষকে ভালোবাসতেন মানুষকে নিয়ে চলতেই পছন্দ করতেন।

তিনি তাঁর মাকে ভালোবাসতেন খুব। মার অবাধ্য হতেন আর মার হাতে নিয়মিত মার খেতেন তবুও মা-ই ছিলো তাঁর জীবনের সবকিছুতেই। বাবা শৈশবেই মারা যাওয়ায় সংসারে অভাব-অনটনের ছায়া পরে। ছোট ভাই-বোনদের লেখাপড়া বিয়ে শাদী এইসব নিয়ে চিন্তায় পড়ে যায় সবাই। বড় মামা তখন ঢাকা ইন্টার কন্টিনেন্টাল হোটেলে বড় পদে চাকুরি করেন, থাকেন ধানমন্ডিতে। বড় মামা আরশাদ সরদার তাঁকে তাঁর পরিবহণ ব্যবসা দেখার দায়িত্ব দেন। এই ব্যবসায় তাঁর মন বসেনি তাঁর মন পড়ে থাকে গ্রামের মানুষ, মেঠো পথ, স্কুল, খেলার মাঠে। তিনি চলে আসেন গ্রামে। স্কুলের ছেলে-মেয়েদের লেখাপড়া গ্রাম্য মানুষদের খোজ-খবর নেয়া এটাই তাঁর ভালোলাগা।

মা কোনো উপায় উপান্তর না দেখে আবারো তাঁর ভাইয়ের কাছে তাঁকে নিয়ে যায়, অতপর আরশাদ সরদার তাঁকে হোটেল ইন্টার কন্টিনেন্টালে চাকুরির ব্যবস্থা করে দেন। কোনো মতে চাকুরি করা, ছুটির আগের দিন গ্রামে ফিরার জন্য অস্থির। গ্রাম এবং মা দুটিই ছিলো তাঁর অস্তিত্বের জায়গা। ইন্টার কন্টিনেন্টাল হোটেলে বেতন পেতেন তিনি আন্তর্জাতিক স্কেলে। সে টাকায় সংসারের হাল ধরেন তিনি । ভাই-বোনদের পড়াশুনা সবকিছুরই দায়িত্ব নেন তিনি। দেশ তখন উত্তাল, ৬৯ এর গণ আন্দোলন শেষে ৭০ এর নির্বাচন সবই কাছ থেকেই দেখেন তিনি। কারণ বড় বড় মিটিংগুলো সব ইন্টার কন্টিনেন্টালেই হতো। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণে ছুটে যান তিনি রেসকোর্সে। কাছ থেকে দেখেন ইয়াহিয়া খান, জুলফিকার আলী ভুট্টো মিটিং করছে ১১ মার্চ থেকে ২৫ মার্চ পযন্ত হোটেল ইন্টার কন্টিনেন্টালে। অতপর যুদ্ধ, ভয়াবহ যুদ্ধ। হোটেল ছেড়ে চলে যান গ্রামে। দেশমাতৃকাকে রক্ষার জন্য যোগ দেন মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে। সম্মূখ যুদ্ধেও অংশ নেন কয়েক স্থানে। নিপীড়িত মানুষের পাশে দাড়ান সাহায্যের হাত নিয়ে। দেশ স্বাধীন হয়, অনেকেই সার্টিফিকেট পাওয়া নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পরেন, তিনি কোনোদিন সার্টিফিকেট সংগ্রহ করেননি কোনো সুযোগ-সুবিধার জন্য চেষ্টাও করেননি। যুদ্ধ শেষে আবারো যোগ দেন ইন্টার কন্টিনেন্টাল হোটেলে। এখানে ভাইদেরকে এবং আত্মীয় স্বজনদের একে একে চাকুরির ব্যবস্থা করেন। একটি বাড়ি ভাড়া করে থাকতেন হোটেলের পাশেই হাতিরপুল বুড়ির বাড়িতে, মনির চৌধুরীদের পাশাপাশি বাড়িতে। তখন ঢাকায় তাঁর গ্রামের এবং পাশ্ববর্তী এলাকার তেমন কোনো লোক থাকতো না। তখন চাঁদপুর ছিল অনেক দূরবর্তী পথ। যোগাযোগ ব্যবস্থা এতো উন্নত ছিলনা। তখন এলাকার মানুষ ডাক্তার দেখাতে, বিদেশে যেতে অথবা বিদেশ থেকে ফিরতে অথবা যেকোনো কাজে আত্মীয়-স্বজনসহ তাঁর বাসাতেই উঠতো। প্রতিদিনই অসংখ্য মানুষের ভীড় থাকতো তাঁর বাসায়। তিনি অতিথি আপ্যায়ন ও গ্রামের মানুষের সেবা ও সহযোগিতাতেই আনন্দ পেতেন।

গ্রামের বাড়িতে তিনি একটি নতুন বাড়ি করেন কয়েক একর জমি নিয়ে। পুকুর কাটেন, ঘর করেন। বাড়িতে ইটের বাউন্ডারি করেন, একটি ডাক বাংলো করেন। ডাক বাংলাটো ছিলো দেখার মতো। দূর গ্রাম থেকেও লোকজন তখন এই বাড়িটি দেখতে আসতো রোজ। বাংলোটি তাঁর বাবা ‘সেকান্দর আলী খান’ এর নামে নামকরণ করেন। বাংলোর দেয়ালে টানিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ, বঙ্গবন্ধু, জাতীয় কবি, সুভাস বসু, মহাত্মা গান্ধী, ইন্দিরা গান্ধী, আইনস্টাইন প্রমূখের ছবি। একটি ডাইনিং + বৈঠক টেবিল তৈরি করেন প্রায় ৩০ জন লোক একসাথে মিটিং করা যায় অথবা খাওয়া যায়। প্রতি শুক্রবার ছুটিতে বাড়িতে যেতেন। বাজার থেকে বড় বড় মাছ কিনতেন, পুকুর থেকে ধরতেন, শাক সবজির আয়োজনে ভরে উঠতো ডাইনিং টেবিল। বাড়ির এবং প্রতিবেশী অসহায় দুস্থ বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের নিয়ে একত্রে খেতেন। আত্মীয়-স্বজনরা নিয়মিত বেড়াতে আসতেন, আত্মীয়দের আপ্যায়ন করতেই তিনি পছন্দ করতেন। বোনের ছেলেরা অনেকেই তাঁর বাসায় থেকে পড়ালেখা করতো। বোনদের সবসময় নানাভাবে সহযোগিতা করতো। ভাই-বোনরা সবাই তাঁকে খুব সম্মান করতো। স্কুলের ম্যানেজিং কমিটিতে সব সময় ছিলেন তিনি। অসহায় শিক্ষার্থীদের নিজ পকেট থেকে বেতন ফরম ফিলাপের ব্যবস্থা করে দিতেন। স্কুলের সার্বিক উন্নয়ন নিয়েই চিন্তা করতেন সবসময়।
চাঁদপুরের মতলব-হাজিগঞ্জ এবং কচুয়া উপজেলার মানুষের ঢাকায় যাতায়াতের তেমন কোনো ভালো ব্যবস্থাপনা ছিলনা, ভালো লঞ্চও ছিলনা। তিনি তখন একটি লঞ্চ কিনেন। নিজের নামে নামরণ করেন ‘মকবুল’-১। অতপর একে একে আরো তিনটি লঞ্চ কিনেন। লঞ্চ গুলোকে তিনি অনেক বড় করেন, বসার জন্য ভালো সোফা-চেয়ার, শোবার জন্য কেবিন, ফেন এর ব্যবস্থা করেন এবং বিনোদনের জন্য টেলিভিশন ও ভিডিওর ব্যবস্থা করেন। উল্লেখ্য যে তিনি প্রথম আধুনিক আরামদায়ক বিনোদনধর্মী সৌখিন লঞ্চের সূচনা করেন ঢাকা টু মতলব। লঞ্চের সুনাম দ্রুত ছড়িয়ে পরে চারদিকে। যাত্রীর ভীড়। তিনি একে একে মকবুল-২, মকবুল ৩ এবং ‘সুজন’ লঞ্চ বের করেন। তিনি নিয়ম করে দেন গরীব মানুষদের ভাড়ার জন্য জোর করা যাবেনা। এজন্য চাঁদপুরের যতো গরীব মানুষ সব এই লঞ্চে ভীড় করতো। ওইসব অঞ্চলের এমপি, মন্ত্রী, চেয়ারম্যান মেম্বার, সম্মানিত সকলেই এই লঞ্চগুলোতে যাতায়াত করতো, মালিক পক্ষ তাঁদেরতো ভাড়া নিতেনই না বরং নানারকম আপ্যায়ন করতেন, কেবিন দিয়ে দিতেন। লঞ্চগুলো প্রায় ১৬ টি ঘাটে ভিড়তো। প্রতি ঘাটে এবং ঐসব অঞ্চলের প্রায় মসজিদ-মাদ্রাসা-এতিমখানাগুলোতে তিনি নানাভাবে নানারকম অনুদান দিয়েছেন। ওইসব এলাকার মাহফিল, যাত্রা- নাটকসহ যতোরকম অনুষ্ঠান হতো লঞ্চগুলো থেকে নিয়মিত সহযোগিতা করতো।

একবার নারায়নগঞ্জের আদমজী জুটমেইলের কয়েকজন কর্মকর্তা –কর্মচারি আসেন তাঁর কাছে। এসে জানান, তাঁরা সপ্তাহে একদিন ছুটি পান, সকালে লঞ্চে উঠলে বিকাল হয়ে যায় বাড়ি ফিরতে। পরিবারের সাথে সময় কাটাতে পারেননা, মালিক সাহেব যদি একটি লঞ্চ রাতে ছাড়েন, তবে তেল খরচ সবাই মিলে দিয়ে দিবেন। তাঁদের কথা শুনে মন খারাপ হলো মকবুল সাহেবের। একটু ইতস্তত করলেন লোকসান হবে ভেবেই কর্মচারিদের কথা ভেবে তিনি নাইট সার্ভিস চালু করেন। প্রথম কয়েকদিন অল্প অল্প যাত্রী হলেও পরবর্তীতে রাতেই যাত্রীর সংখ্যা বেড়ে গেল। প্রতিরাতে মকবুল ১ এবং ২ লঞ্চ দুটি একটি নারায়নগঞ্জ থেকে রাত ১১ টায় অপরটি মতলব থেকে রাত ১০.০০ টায় ছাড়তো। রাতে ঘুমিয়ে সকালে কেউ অফসি-ব্যবসা করতে পারেতো, কেউবা পরিজনদের কাছে পৌছে যেতো। রাতে লঞ্চ চলতে পারে এই কনসেপ্টটি তিনি প্রতিষ্ঠিত করেন। সারাদিন হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের অফিস কাজ শেষে চলে আসতেন নারায়নগঞ্জে। রেলস্টেশনের পাশের মসজিদের দোতলায় ছিল অফিস কক্ষ। লঞ্চের কর্মচারিরা ভিড় করতো সকলের সুখ-দুখ শুনতেন। অতপর রাতে ঘাটে যেতেন। রাত ১১.০০ টায় যে লঞ্চটি ছাড়তো, তিনি সেই লঞ্চের হিসেব দেখে দেখে যেতেন, অপরদিক থেকে আসা লঞ্চটি এসে উত্তাল মেঘনা নদীর মাঝে মুখোমুখি ভিড়তো, তিনি এই লঞ্চ থেকে ওই লঞ্চে লাফ দিয়ে চলে যেতেন। আসতে আসতে ওই লঞ্চের হিসেবও দেখতেন। নারায়নগঞ্জে লঞ্চটি পৌছতে পৌছতে ফজরের আজান পরে যেতো। তিনি লঞ্চের ওয়াস রুমে ফ্রেস হয়ে চড়ে বসতেন ঢাকাগামী বাসে। ঢুকতেন অফিসে। অমানুষিক পরিশ্রম করতেন তিনি। তিনি একা মানুষ। চাকুরি করার কারণে লঞ্চগুলোতে সার্বক্ষণিক দেখভাল করতে না পারায় কর্মচারিরা অনেক লুটপাট করতো। চারটি লঞ্চ এতো আয় করা সত্বেও তিনি তেমন লাভবান হতে পারেননি। অসৎ কাজ দুর্নীতি করা সত্বে কখনো কোনো কর্মচারিকে চাকুরিচ্যুত করেননি, জোড়ে একটি কথাও বলেননি। ছোটে বড় সকলকে আপনি বলে সম্বোদন করতেন। বাংলাদেশে লঞ্চ সার্ভেয়ারদের পড়াশুনা নেই সকলেই জানে। এখানে প্রতিবছর টাকা দিলেই ফিটনেস দেওয়া হতো, না দিলে আনফিট দেখানো হতো। মকবুল সাহেব তাঁর সবগুলো লঞ্চ বুয়েট ইঞ্জিনিয়ার দ্বারা ডিজাইন করে অনুমোদন নিয়ে তৈরি করলেও তাঁর কাছেও লঞ্চপ্রতি ১ লক্ষ টাকা করে দাবী করে সার্ভেয়ার। তিনি টাকা দিতে অস্বীকার করলে তাঁকে নানারকম ভোগান্তিতে ফেলেন। তিনি অপমানিত বোধ করেন। রাস্তা হয়ে যাওয়ায় লঞ্চের যাত্রি কমতে থাকে। পরবর্তিতে একে একে সবগুলো লঞ্চ বিক্রি করে দেন। এখনো লঞ্চগুলো তাঁর নামেই চলে। চাঁদপুরের মন্ত্রী এমপিদের চেয়ে জনপ্রীয় ছিলেন মকবুল সাহেব। ঢাকা টু মতলবে প্রথম যাত্রীবাহি বাস চালু করেন ‘ জৈনপুর’ বাস সার্ভিস। পরিবহণ ব্যবসা তাঁর সখ হলেও এই ব্যবসায় কখনোই নিজেকে মানিয়ে নিতে পারেননি তিনি। মিথ্যে-বানোয়াট-চিটিং অহরহ। দলীয় চাঁদা, রংবাজি, এমডি-চেয়ারম্যানের অসভ্যতা-পুলিশি দুর্নীতি-কর্মচারিদের লুটপাট এগুলোর সাথে খাপ খাওয়াতে পারেননি কখনো। প্রায় ৩০ বছরের লঞ্চ ব্যবসা জীবনে তিনি কখনো মালিকদের অফিসেই যাননি। সবচেয়ে বড় লঞ্চগুলোর মালিক হওয়া সত্বেও তিনি চেয়ারম্যান বা কিছুই হতে চাননি। বাস মালিকরা তাঁকে বারবার চেয়ারম্যান করতে চাইলেও তিনি এই পদটি কখনোই নেননি। তিনি সব সময় ঝামেলা এড়িয়ে চলার চেষ্টা করতেন। এমনকী রাজনীতিও। তিনি স্কুল-কলেজের জন্য অনেক কাজ করলেও কখনোই সভাপতি বা কিছুই হননি। তিনি একজন মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন দল-মত নির্বেশেষে সকলের সাথেই মিলে-মিশে চলতেন।

বিভন্ন দলীয় এমপি- মন্ত্রী-নেতৃবৃন্দ তাঁর বাড়িতে আসতেন তাঁকে জনসভায় নিমন্ত্রণ জানাতেন কিন্তু কখনোই যেতেন না। জেলা আওয়ামী সভাপতি সামসুল হক ভূইয়া এলেন বাড়িতে, ঢাকার মেয়র মোঃ হানিফ গেলেন একবার মেয়র থাকাকালীন তাঁর বাড়ির সামনের মাঠে জনসভায়, মতিয়া চৌধুরী তাঁর বাড়িতে গিয়ে এক দুপুরে নেতা-কর্মী মিলে খাওয়া দাওয়া করলেন কিন্তু একমঞ্চে বসলেন না। তাঁর ভাগ্নি জামাই সাবেক মন্ত্রী ও এমপি ছিলেন নূরুল হুদা। তিনি হুদা সাহেবের জন্য ও কখনো ভোট চাইতে জাননি। জনগণ চেয়েছিলেন তিনি যেনো নির্বাচনে আসেন, কিন্তু তিনি এসবের সাথে নিজেকে মিলাতে পারেননি কখনো। দেশ আজ কয়েকভাগে বিভক্ত দলীয় কোন্দলে। তিনি দলমত নির্বিশেষে সকলের হয়ে থাকতে চেয়েছেন এবং থেকেছেন এবং সকল দলের অন্যায়-লুটপাটের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে বলে গেছেন।

তিনি নারায়নগঞ্জের নামকরা ডাক্তার নুরুল ইসলাম সাহেবের সাথে চুক্তি করে যৌথভাবে স্বাস্থ্যসেবার জন্য কাজ করেছেন। ডা: নুরুল ইসলাম বলেন-‘ বিভিন্ন গ্রামে বিভিন্ন স্কুলে নানাসময়ে চক্ষু শিবির করেছেন। ঢাকা থেকে চক্ষু ডাক্তারদের টিম নিয়ে আসতেন কয়েকদিনের জন্য। বিভিন্ন গ্রামের বয়স্ক পুরুষ-মহিলারা ডাক্তার দেখাতেন, চোখের ড্রপ ও ওষুধ ফ্রি দেওয়া হতো, ছানি অপারেশন করা হতো। এইরকম শত শত গরীব অসহায় রোগীদের চিকিৎসা সেবা দিয়ে গেছেন সবসময় নিরবে। ডাক্তারদের থাকা-খাওয়াও আপ্যায়নের ব্যবস্থা করতেন। শুধু তাই নয় এলাকার রোগীরা সব সময় তাঁর লঞ্চে করে চলে যেতেন নারায়নগঞ্জে। ডাক্তার নূরুল ইসলাম ও অন্যান্য ডাক্তাররা দেখতেন এবং যতোরকম পরীক্ষানিরিক্ষা এবং ওষুধপত্র সবখরচ বহণ করতেন তিনি। এইরকমভাবে করে গেছেন সবসময় মানুষের জন্য।

তিনি ব্যবসাসহ সকলকাজ করেছেন ভাইদেরকে সাথে নিয়ে। ভাইবোনদের মধ্যে কোনোদিন একটু কথাকাটাকাটিও হয়নি তাঁর বিশাল ব্যাক্তিত্বের কারণে। তিনি তাঁর মা’র কথার বাহিরে একবিন্দুও যাননি। মৃত্যুঅবদি মায়ের শিয়রের কাছেই ছিলেন। তিনি যতো জমি-জমা বা সম্পদ করেছেন সব করেছেন তাঁর মায়ের নামে। ‘মা’ মৃত্যুর আগে বলেছিলো, তোর ভাইবোন সবাইতো প্রতিষ্ঠিত, আমি থাকতেই তোর সম্পদগুলো তোর নামে লিখে নে’। তিনি চেয়েছেন তাঁর সম্পদগুলো তাঁর ভাইবোন সকলেই যেনো পান। তিনি জীবীত থাকাকালীন তাঁর ভাইবোনেরা সবাই চেয়েছিলো তাঁর নামে লিখে দিতে, তিনি কোনোভাবেই রাজি হননি। তাঁর ভাই ও বোনেরা তাঁকে খুব সম্মান করতেন। এলাকার মানুষ সবসময় এই পরিবারটিকে সম্মান করতো এবং করেন শুধু চমৎকার বন্ডিংয়ের কারনে।
তাঁর এতো কর্মকান্ড কিছুই হতো না যদি তাঁর ধৈয্যশীলা স্ত্রী না থাকতো। তাঁর সকল কাজেই স্ত্রী সাপোর্ট করে গেছেন। নিরব নিভৃতে আত্মীয় স্বজন ও প্রতিবেশীদের সকল রকম সেবা করে গেছেন। উচু-নিচু ধনি-গরীব কোনো ভেদাভেদই তিনি রাখেননি। ডায়াবেটিকস, প্রেসার, উচ্চরক্তচাপ ও কিডনি রোগে ভুগে তিনি মারা যান ২০১৭ সালের ১৮ নভেম্বর।

তার মা ২০১৫ সালের এপ্রিল মাসে মারা যান, কয়েকদিনপরেই স্ত্রীকে হারান, তাঁর কয়েকদিনপর তাঁর আপন বড়বোন রাজিয়া খানমকে ২০১৮ সালে ১৬ ডিসেম্বর তারিখে, শাশুড়ি ছাড়াও নিকটতম প্রতিবেশী ও কয়েকজন বন্ধু মারা যাওয়ায় তিনি মানসিক চাপে পরে এবং ব্রেইন স্ট্রোক করেন। অতপর চিকিৎসায় অনেকটা সুস্থ হলেও একাকীত্বে ভুগে ভুগে তিনি ২০২০ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি তারিখের সকালবেলায় দেহত্যাগ করেন। মানবতার সম্রাটের চলে যাওয়ার খবরটি এলাকায় ছড়িয়ে পরলে হাজার হাজার মানুষের ঢল নামে। আত্মীয়-স্বজন প্রতিবেশীর নিরবকান্নার ঢল নামে। নারায়নপুর উচ্চবিদ্যালয় এবং নারায়নপুর বালিকা বিদ্যালয় ছুটি ঘোষণা করে। জৈনপুর পরিবহনের সকল গাড়িতে এবং সকল ড্রাইভার হেলপার কালো ব্যাচ ধারন করে, লঞ্চ মালিক ও শ্রমিকদের মধ্যে শোকের ছায়া নেমে আসে। মহান এই মানুষের বিদায়ে হাজারো হাজারো মানুষ জড়ো হয় তারই প্রতিষ্ঠিত স্কুল মাঠ ও ঈদগাহে । জানাজায় উপজেলার চেয়ারম্যান, ইউনিয়ন চেয়ারম্যান, ভাই গিয়াস উদ্দিন খান, ডাক্তার নূরুল ইসলাম সাহেব, বড় ছেলে ড. আফজাল হোসেন খানের স্মৃতিকথায় শোকের ছায়া নেমে আসে। জানাজা শেষে বাড়ির পাশের মসজিদের পাশে পারিবারিক গোরস্তানে তাঁর মা ও স্ত্রীর পাশে সমাহিত করা হয়।

ভাগিনা ও ভাইয়েরা মিলে সকল আত্মীয়-স্বজন এবং এলাকার মানুষদের আমন্ত্রণ জানিয়ে ৪ র্থ দিনের দিন প্রায় আটহাজার মানুষের উপস্থিতিতে দোয়া-মোনাজাত শেষে খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়।

লেখক: ড. আফজাল হোসেন খান,

সহকারী অধ্যাপক, জার্নালিজম অ্যান্ড মিডিয়া কমিউনিকেশন বিভাগ

গ্রিন বিশ্ববিদ্যালয় অব বাংলাদেশ

 

দেশইনসাইডার/এ.আর