সদ্য শেষ হয়ে যাওয়া যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন নিয়ে সরগরম ছিল পুরো বিশ্ব। বিশ্বের শীর্ষ ধনী দেশটির হাল কে ধরতে যাচ্ছেন, ডোনাল্ড ট্রাম্প নাকি জো বাইডেন- এ নিয়ে ছিল সবাই উদগ্রীব।

তবে এই নির্বাচন নিয়ে যেসব দেশ সবচেয়ে উদ্বিগ্ন ছিল, এর মধ্যে সৌদি আরব অন্যতম। বিশেষ করে রিয়াদের যুবরাজ এমবিএস খ্যাত মোহম্মদ বিন সালমানের চিন্তা কিছুটা বেশিই ছিল। কারণ তিনি ভালো করেই জানেন বাইডেন নির্বাচিত হওয়া মানে সৌদি আরবের চারপাশে ট্রাম্প প্রশাসনের বিছিয়ে রাখা নিরাপত্তা বেষ্টনীর সমাপ্তি।

এসব দিক বিবেচনায় সৌদি আরবের দুর্ভাগ্যই বলা চলে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন বাইডেন, যিনি অনেক আগে থেকেই সৌদি আরব ও ইয়েমেন যুদ্ধ নিয়ে নিজের অবস্থান পরিষ্কার করেছেন। সম্প্রতি সৌদি আরবের মানবাধিকার ভঙ্গের রেকর্ড, ইয়েমেনের সাথে সম্পর্ক, আঞ্চলিকভাবে আধিপত্য বিস্তারের জোর প্রচেষ্টার নজির দেখে যে বাইডেন প্রশাসন এখানে বিশাল বিনিয়োগ করবেন না, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

এমবিএস মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প, তার জামাতা জারেড কুশনার ও সৌদিপন্থী মধ্যপ্রাচ্যের মার্কিন উপদেষ্টাকে নিজের দলে টানতে পেরেছিলেন। প্রিন্স সালমান তাদের আশ্বস্ত করেছিলেন ইরানের আপত্তি থাকলেও যুক্তরাষ্ট্র থেকে হাজার হাজার কোটি ডলারের অস্ত্র কিনবে সৌদি আরব। এছাড়া ইসরায়েলের নির্দেশ মেনে মার্কিন মিত্রদের চাওয়া অনুযায়ী সবকিছু করারও প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন প্রিন্স সালমান। কিন্তু প্রেসিডেন্ট বাইডেনকে হয়তো এতটা সহজে ম্যানেজ করতে পারবেন না তিনি।

বাইডেন সৌদি আরবকে ‘আগ্রাসী রাষ্ট্র’ হিসেবে অভিহিত করে ইয়েমেনের সাথে ‘ধ্বংসাত্মক যুদ্ধ’ বন্ধ ও রিয়াদের সাথে সম্পর্ক পুনরায় যাচাইয়ের আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি আরো বলেছেন, ‘ইয়েমেনের নিষ্পাপ শিশু ও নাগরিকদের হত্যা করছে সৌদি আরব।’ গত বছর কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশনে বাইডেন বলেছিলেন, ‘মধ্যপ্রাচ্যে আমেরিকার অগ্রাধিকারের বিষয়গুলো ওয়াশিংটনে নির্ধারিত হবে, রিয়াদে নয়।’

অক্টোবরে নির্বাচনি প্রচারে বাইডেন বলেছেন, ‘বাইডেন-হ্যারিস প্রশাসনে সৌদি আরবের সাথে সম্পর্ক পুনরায় যাচাই করা হবে। ইয়েমেন যুদ্ধে সৌদি আরবের পক্ষাবলম্বন করাও বন্ধ করবে ওয়াশিংটন। আর নিশ্চিতভাবেই বলা হচ্ছে, অস্ত্র বিক্রি অথবা তেল ক্রয় কোনো বিনিময়েই আমেরিকা নিজেকে বিকোবে না।’

ডেমোক্রেটিক পার্টিতেও ইদানিং এ ধরনের কথা আলোচিত হচ্ছিল। গত সপ্তাহেই ইউএস রিপ্রেজেন্টেটিভ রো খান্না টুইটারে বলেন, ডেমোক্র্যাটদের উচিত ‘ইয়েমেন যুদ্ধে সৌদি আরবকে তহবিল প্রদান বন্ধ করা।’ ডেমোক্র্যাট দল থেকে সৌদি আরবকে শাস্তি প্রদানের জন্য চাপ দেয়ার কারণগুলো পরিষ্কার- ইয়েমেন যুদ্ধে অব্যাহত বর্ধনশীল মানবিক ক্ষতি, ২০১৮ সালের অক্টোবরে ইস্তানবুলে সৌদি কনস্যুলেটের ভেতর সাংবাদিক জামাল খাসোগি হত্যাকাণ্ড এবং এসব ইস্যুতে সৌদি আরবকে ট্রাম্প প্রশাসনের মাত্রাতিরিক্ত সমর্থন। খাসোগি হত্যাকাণ্ডে অভিযুক্ত যুবরাজ এমবিএসকে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প আগলে রাখলেও তার দলের অনেকেই মনে করেন যুবরাজকে বিচারের আওতায় আনা উচিত ছিল।

নির্বাচনি প্রচারে দেয়া নানা প্রতিশ্রুতি ও আগে প্রকাশিত অভিব্যক্তিতে এটি পরিষ্কার যে, ট্রাম্প আমলে যুক্তরাষ্ট্র মধ্যপ্রাচ্যে যে বিষয়গুলো অগ্রাধিকারে রাখত, বাইডেন সে পথে হাঁটবেন না। যুক্তরাষ্ট্রের মিত্রতা পেতে নতুন প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে দাঁড়িয়েছেন সংযুক্ত আরব আমিরাতের (ইউএই) যুবরাজ মোহাম্মদ বিন জায়েদ। তিনি ইতিমধ্যে ইসরায়েলের সাথে সম্পর্ক গড়ে তুলেছেন ও এমবিএসের মতো এতটা বেপরোয়া নন। ফলে বাইডেন প্রশাসনের জন্য জায়েদ তুলনামূলক নির্ভরশীল সহযোগী হতে পারেন।

আরো ধারণা করা হচ্ছে, বাইডেন প্রশাসনের সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সম্পর্ক পুনর্নির্মাণে অগ্রবর্তী হতে পারে তেহরান। বিশেষ করে এই প্রশাসন যদি বারাক ওবামার শাসনকালের মতো মার্কিন নীতিতে আরো ভারসাম্য আনার প্রতিশ্রুতি দেয় ও সৌদি-ইরানের আঞ্চলিক আধিপত্যের খেলার মাঠ থেকে নিজেকে সরিয়ে নেয়, তাহলে যুক্তরাষ্ট্রের দিকে আরো একধাপ এগিয়ে যাবে ইরান।
বাইডেন আগেই জানিয়েছেন, নতুন পরমাণু চুক্তির মাধ্যমে ইরানের সাথে তিক্ততা কমিয়ে আনার চেষ্টা করবেন তিনি ও ইসরায়েলের নতুন কোনো দখলদারিত্বে সমর্থন দেবেন না। যুক্তরাষ্ট্রের সাথে এভাবে দূরত্ব তৈরি হলে রিয়াদের প্রতিক্রিয়া কেমন হবে, তা এখনো পরিষ্কার নয়। ওয়াশিংটনের সুদৃষ্টি ফিরে পেতে ইসরায়েলের সাথে ঘনিষ্ঠতা বাড়াতে চেষ্টা করতে পারে রিয়াদ। তবে তাতেও বাইডেন প্রশাসনে যুক্তরাষ্ট্রের প্রিয়পাত্রের অবস্থান ফিরে পাবে না সৌদি আরব।

তবে এটিও ঠিক যে, গত চার বছর ধরে হোয়াইট হাউস যে বিদেশনীতির ওপর চলেছে, তা থেকে বের হওয়া বাইডেনের জন্য সহজ হবে না। সৌদি আরব ও ইসরায়েলের প্রসঙ্গ এলে পরিস্থিতি আরো খানিকটা কঠিন হয়ে উঠবে। ট্রাম্প আমলে এ দুটি দেশ যুক্তরাষ্ট্র থেকে সর্বাধিক কূটনৈতিক ও রাজনৈতিক সমর্থন পেয়েছে। ফলে চার বছর ধরে চলমান একটি অবস্থার রাতারাতি পরিবর্তন করা বাইডেনের পক্ষে সহজ হবে না। এছাড়া নির্বাচনি প্রচারে দেয়া প্রতিশ্রুতি ও বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর দেশের নেতার বাস্তব কার্যক্রমের মধ্যে অনেক পার্থক্য রয়েছে। ঐতিহাসিকভাবেই দেখা গেছে, যুক্তরাষ্ট্রের সব প্রেসিডেন্টই সৌদি আরবের সাথে এক ধরনের সখ্য বজায় রেখেছেন।

অবশ্য বিশ্লেষকরা বলছেন, সৌদি আরবের ক্ষেত্রে বাইডেন সম্ভবত একটি ভারসাম্যপূর্ণ মনোভাব দেখাতে পারেন। তিনি এই দেশটির সাথে ট্রাম্পের মতো মাখোমাখো সম্পর্কও রাখবেন না, আবার অনেক ডেমোক্র্যাটের চাওয়া অনুযায়ী, রিয়াদের সাতে বিচ্ছিন্নতাও সৃষ্টি করবেন না।

রাইস ইউনিভার্সিটির ফেলো ক্রিশ্চিয়ান উলরিশেন আলজাজিরাকে এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘সৌদি নেতৃত্বের হোয়াইট হাউস থেকে শর্তহীন সহযোগিতা পাওয়ার প্রত্যাশায় জল ঢেলে দিতে পারে বাইডেন প্রশাসন। যুক্তরাষ্ট্র ও সৌদি দুই দেশের স্বার্থের উপযোগী করেই পরবর্তী লক্ষ্যগুলো পুনর্নির্মাণ হবে। ইয়েমেন থেকে সৌদি আরবকে বিচ্ছিন্ন করার উপায়ও এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে।’

তিনি আরো বলেন, ‘সৌদি আরবের সাথে ব্যবসায়িক সম্পর্ক নষ্ট করতে চাইবে না বাইডেন প্রশাসন, আর এ কারণেই তাদের নতুন নীতিতে যেসব কার্যক্রম থাকবে সেখানে সৌদি আরবের কাছে অস্ত্র বিক্রি বাড়ানোর লক্ষ্য থাকতে পারে। এছাড়া বাইডেনের উপদেষ্টারা সৌদি আরবকে শত্রুদের হাত থেকে রক্ষা করার প্রতিশ্রুতি ধরে রাখতে চাইবেন। তবে যুক্তরাষ্ট্র অস্ত্র বিক্রিতে জোর দিলেও তারা নিশ্চিত হতে চাইবে- এটি ধ্বংসাত্মক নয়; বরং প্রতিরক্ষামূলক হবে।’

প্রসঙ্গত, ২০১৪ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের বিক্রি করা অস্ত্রের এক-চতুর্থাংশের ক্রেতা ছিল সৌদি আরব। স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউট এ তথ্য জানিয়েছে। ইয়েমেন যুদ্ধে ২০১৫ সালের মার্চ থেকে সামরিক হস্তক্ষেপ শুরু করে সৌদি আরব। ট্রাম্প প্রশাসন থেকে সৌদি সরকার এতদিন ইয়েমেন যুদ্ধে নিজেদের হস্তক্ষেপ নিয়ে সমর্থন পেয়ে এসেছে। ইয়েমেনে হুথি বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে সৌদি কোয়ালিশনের যুদ্ধ ও এর ফলে সৃষ্ট মানবিক বিপর্যয় নিয়ে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা অসন্তুষ্ট ছিলেন। সেসময় তার ভাইস প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনও একই মত পোষণ করতেন। এর জের ধরে প্রেসিডেন্ট ওবামা সৌদি আরবে সামরিক ও গোয়েন্দা সহযোগিতা কমিয়ে দেন; কিন্তু ট্রাম্প ক্ষমতায় আসার পরপরই সেসব সাহায্য পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেন ও বাড়িয়ে দেন।

সৌদি আরবে যুক্তরাষ্ট্র শুধু হাজার হাজার কোটি ডলারের অস্ত্রই বিক্রি করেনি, ইয়েমেন যুদ্ধে সৌদি আরবের পাশে থাকতে লজিস্টিক ও ইন্টেলিজেন্স সহায়তাও দিয়েছে। এমনকি জামাল খাসোগি হত্যাকাণ্ডের পর মার্কিন কংগ্রেসকে পাশ কাটিয়ে সৌদি আরব ও ইউএইর কাছে ৮০০ কোটি ডলারের অস্ত্র বিক্রি করেছে ট্রাম্প প্রশাসন। ইয়েমেন যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ বন্ধ করতে দ্বিপক্ষীয় মতৈক্যের পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৯ সালের এপ্রিলে কংগ্রেসের উভয় কক্ষে একটি বিল পাস হয়। তখন এ বিলে একমাত্র প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পই ভেটো দিয়েছিলেন। আত্মপক্ষ সমর্থন করে ট্রাম্প বলেছিলেন শুধু ‘আলোচনার মাধ্যমে সমঝোতার’ মাধ্যমেই ইয়েমেনে শান্তি প্রতিষ্ঠা সম্ভব। এখন দেখার বিষয় হচ্ছে বাইডেন এ বিষয়ে কেমন ভূমিকা নেন।

ইয়েমেনে জাতিসংঘের সিকিউরিটি কাউন্সিল প্যানেল অব এক্সপার্টের সাবেক সদস্য গ্রেগরি জনসেন বলেন, ‘আমি মনে করি, ইয়েমেনে যুদ্ধ বন্ধ করতে বাইডেন প্রশাসনের হাতে ইতিবাচক সবকিছুই রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রই সম্ভবত একমাত্র দেশ যদি তারা চায়, তাহলে ইয়েমেন যুদ্ধ বন্ধে সৌদি আরবের ওপর সর্বোচ্চ কূটনৈতিক চাপ দিতে পারে।’

অবশ্য ইয়েমেনে সৌদি হস্তক্ষেপ বন্ধ করলেই যে দেশটিতে চলমান বিবাদের অবসান হবে তা কিন্তু নয়। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘সৌদি নেতৃত্বে চলমান ইয়েমেন যুদ্ধ বন্ধ প্রথম পদক্ষেপ। দ্বিতীয়টি আরো কঠিন- দেশটিতে চলমান গৃহযুদ্ধের অবসান।’

যুক্তরাষ্ট্র-সৌদি আরবের সম্পর্ক এখন একটি প্রান্তসীমায় দাঁড়িয়ে আছে, যেখান থেকে দুই দেশের সম্পর্ক নতুনভাবে শুরু হবে, যা সার্বিকভাবে সৌদি প্রশাসনের জন্য সন্তোষজনক নাও হতে পারে।